Friday 29 June 2012

পালের নাও


পালের নাও 

জসীমউদ্দীন



পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও—
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও |
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’,
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!

কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে |
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায় |
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও |
তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী |
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে |
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি |
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও—কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও,—
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার—লোকে গেছে বলি |
পারাপার দুই নদী—মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর |

এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া—
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া |
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে ।

সৃষ্টিশীলতার প্রতি


সৃষ্টিশীলতার প্রতি

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



শুধু তোমাকে সালাম– আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস– শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে–
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে– আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর– সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ।

কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড


কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।

গ্রিনরোড


গ্রিনরোড

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলো মটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে

আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল–
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ।

পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ


পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি– মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়–
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে।

একটি গ্রামের কথা


একটি গ্রামের কথা

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



লোকে জিগেস করে—
তোমার কবিতায় এত বিষণ্ন রঙ কেন আজকাল?
কোনো জবাব দিই না।
বলব কি পিকাসোর উত্তরটি?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
পিকাসো প্যারিসে তাঁর স্টুডিওয়।
স্পেনের একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেল জর্মান বোমা বর্ষণে।
গের্নিকা।
পিকাসো সেই বিধ্বংস গ্রামের ছবি আঁকলেন ক্যানভাসে।
জর্মান সৈনিকরা প্যারিসে ঢুকে পড়ল একদিন।
স্টুডিওয় ঢুকে পিকাসোকে জিগেস করল—
এই ছবি কি তুমি এঁকেছ?
উত্তর দিলেন পিকাসো—
না। এসব এঁকেছ তোমরা।—
—মুশকিল হলো আমি মুখ ফুটে কথা বলতে পারি না।
না হলে বলতাম লোকজনকে—
যে-বিমর্ষতা দেখছ আমার কবিতায়,
তার কারণ এক ভয়ংকর বোমারু বিমান।
আমার শান্ত সবুজ নদী-বয়ে যাওয়া গ্রামটির ওপরে
অহৃদয় বোমার পর বোমা ফেলে
এ রকম তছনছ করে দিয়েছে যে—
তাকে আমি চিনি।
শুধু তার নাম আমি তোমাদের বলব না।
পিকাসোর মতো সাহস নেই আমার।
তখন শুধু সেই শ্যামল গ্রামটির স্মৃতি
আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এত।
তাই আমার কবিতায় আজকাল দ্যাখো এত বিমর্ষতা।
আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।
আমার সেই গ্রামে তাবত্ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
শুধু একটি গাছ
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যার ডালে একটিও পাখি বসে না আজ আর।
যার কোনো ফুল ফোটে না।
কোনো ফলও না।
শুধু কী এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
আমি সেই গাছ।
সেই গাছ।