Friday 29 June 2012

পালের নাও


পালের নাও 

জসীমউদ্দীন



পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও—
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও |
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’,
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!

কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে |
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায় |
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও |
তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী |
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে |
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি |
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও—কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও,—
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার—লোকে গেছে বলি |
পারাপার দুই নদী—মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর |

এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া—
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া |
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে ।

সৃষ্টিশীলতার প্রতি


সৃষ্টিশীলতার প্রতি

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



শুধু তোমাকে সালাম– আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস– শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে–
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে– আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর– সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ।

কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড


কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।

গ্রিনরোড


গ্রিনরোড

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলো মটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে

আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল–
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ।

পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ


পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি– মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়–
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে।

একটি গ্রামের কথা


একটি গ্রামের কথা

আব্দুল মান্নান সৈয়দ



লোকে জিগেস করে—
তোমার কবিতায় এত বিষণ্ন রঙ কেন আজকাল?
কোনো জবাব দিই না।
বলব কি পিকাসোর উত্তরটি?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
পিকাসো প্যারিসে তাঁর স্টুডিওয়।
স্পেনের একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেল জর্মান বোমা বর্ষণে।
গের্নিকা।
পিকাসো সেই বিধ্বংস গ্রামের ছবি আঁকলেন ক্যানভাসে।
জর্মান সৈনিকরা প্যারিসে ঢুকে পড়ল একদিন।
স্টুডিওয় ঢুকে পিকাসোকে জিগেস করল—
এই ছবি কি তুমি এঁকেছ?
উত্তর দিলেন পিকাসো—
না। এসব এঁকেছ তোমরা।—
—মুশকিল হলো আমি মুখ ফুটে কথা বলতে পারি না।
না হলে বলতাম লোকজনকে—
যে-বিমর্ষতা দেখছ আমার কবিতায়,
তার কারণ এক ভয়ংকর বোমারু বিমান।
আমার শান্ত সবুজ নদী-বয়ে যাওয়া গ্রামটির ওপরে
অহৃদয় বোমার পর বোমা ফেলে
এ রকম তছনছ করে দিয়েছে যে—
তাকে আমি চিনি।
শুধু তার নাম আমি তোমাদের বলব না।
পিকাসোর মতো সাহস নেই আমার।
তখন শুধু সেই শ্যামল গ্রামটির স্মৃতি
আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এত।
তাই আমার কবিতায় আজকাল দ্যাখো এত বিমর্ষতা।
আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।
আমার সেই গ্রামে তাবত্ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
শুধু একটি গাছ
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যার ডালে একটিও পাখি বসে না আজ আর।
যার কোনো ফুল ফোটে না।
কোনো ফলও না।
শুধু কী এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
আমি সেই গাছ।
সেই গাছ।

Tuesday 15 May 2012

ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ জানে


ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ জানে

নিলয় আহসান



ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ জানে,

জানে রাতের শুকতারা, বিরোহিনী রাত জানে,
জানে প্রানের নীল ভোমরা, চাওয়া আমার সবে জানে,
জানেনা তোমার হ্র্দয় অফিসের ডাকহরকরা।
...
শিউলি ফুল ও জানে,
জানে ওই ঝরা পাতা,
প্রেম উপন্যাসের মলাট জানে,
জানে ভালোবাসার কাব্য খাতা,
চাওয়া আমার সবে জানে,
জানেনা তোমার খামকেয়ালি শুভ্র তারা।

বনের টিয়া ও জানে,
জানে খেয়ার মাঝি,
আকাশ ঝরা বৃষ্টি ও জানে,
জানে প্রেমিকের আঁখি,
চাওয়া আমার সবে জানে,
জানেনা তোমার আঙর ভাঙা চোখের জলেরা।

ভালোবাসা খুব ব্যথার নকশা,
আঁকা-আঁকি সারাবেলা,
খই ফোটা ভোর নীলিমায় হারায়্,
ক্যানভাস তবু ছন্নছেড়া।

এক জন্ম


এক জন্ম

তারাপদ রায়



অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু'জনেই দুজনকে বলবো,
'অনেকদিন দেখা হয়নি'।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

আমার ভাঙ্গা কান্নাগুলো


আমার ভাঙ্গা কান্নাগুলো

তাসলিম রেজা



তাহাকে ভালবাসিবার লোভ আমি সামলাইয়াছি
যখন আদি-অন্তের সেতুর মাঝখানে দাঁড়াইয়া
ভালবাসার পদ্ম-জলে দেখিয়াছি
... লাল-লাল নীল-নীল ছোপ-ছোপ স্বার্থ!
যে চলিয়া যাইবে তাহাকে জড়াইয়া রাখিবার স্বার্থ নয়
এই স্বার্থ যে চলিয়া গেল তাহার মঙ্গল কামনায় প্রদীপ জ্বালাইবার
অথবা তাহার রাখিয়া যাওয়া ছায়া-অনলে নিজে জ্বলিবার।
স্মৃতিরা আজন্ম জ্বলিয়াই গেল, তবু ছাই হইল না

উর্বর দেহ-জমিনে বালুকা-মন লইয়া যাহারা চলিল
তাহারা প্রেমিক
প্রেমিকদের ভালবাসা ঘন্টাব্যাপী বিছানা ভ্রমণ
প্রেমিকদের চুম্বনের দাগ স্নানের প্রথম জলেই খসিয়া যায়
তাহাকে প্রেমিক প্করিবার সকল আয়োজন বিসর্জন দিয়াছি
যখন দেখিয়াছি হৃদয় হইতে তাহার দেবতা প্রিয় হাস্য মুখ
জীবনব্যাপী বরষার জলেও মুছিবে না

আমি সহস্র পুরুষের শার্টের কামুক গন্ধ নাকে শোঁকাইয়া বলি নাই
আমি সাধু
আমি একজন পুরুষের এক মুঠো ভালবাসা চাহিবার দন্ডে দন্ডিত
যাহার কাছে গোটা পৃথিবী এক খাঁচা শূন্য কারাগার, তাহাকে
প্রভু কোন কারাগারের ভয় দেখাইলেন তবে?
... আমার ধারাল কষ্টে হৃদয় ফাড়িয়া ছিন্ন, আর আমি বসিয়া কান্না ভাঙ্গি
যখন আমার ভাঙ্গা কান্না আরও ভাঙ্গিল, কান্নার টুকরা সাজাইয়া লিখিলাম-
তাহাকে ভালবাসিব বলিয়াই ভাল না বাসিবার শপথ; অস্থি-মাংস-মজ্জায়......

এখনো তুমি


এখনো তুমি

তসলিমা নাসরিন



ভালোবাসা বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
ঘৃণা বলতে এখনো তোমাকে
সংসার বলতে এখনো তোমাকে বুঝি
সুখ বলতেও আমি এখনো তোমাকে
কত টুকু পশু আছে, কতটা হিংস্রতা
কতটা দানব থাকে একজন মানুষের দেহে
তোমাকে আমল ছুঁয়ে যেনে, আমি সমস্ত জেনেছি
তোমার তকের নিচে কত টুকু ক্লেদ
কতটা দ্রুদতা
চোখের তারায় তুমি কতটা রুখ পাপ
শরীলের ঘ্রাণ শুকে শুকে আমি সকল বুঝেছি
স্বপ্ন বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
কষ্ট বলতে এখনো তোমাকে
চুম্বনে তোমার লালা থেকে চুষে নেই
সংক্রামক ব্যাধি

তোমাকে আরোগ্য করি
তোমাকে শুশ্রূষা করি
তোমাকে নির্মাণ করি আমার বিনাশে
জীবন বলতে এখনো তোমাকে বুঝি
মৃত্যু বলতেও আমি এখনো তোমাকে।

কত ভালবাসি


কত ভালবাসি

কামিনী রায়




জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি-
"মা তোমারে কত ভালবাসি।"
"কত ভালবাস ধন ?" জননী সুধায়।
... "এ-তো-" বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।

"তুমি মা আমারে ভালবাস কত খানি ?"
মা বলেন, "মাপ তার আমি নাহি জানি।"
"তবু কতখানি, বল !" "যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।" "নহে তার পরে ?"
"তার বাড়া ভালবাসা পারিনা বাসিতে"
"আমি পারি।" বলে শিশু হাসিতে হাসিতে।

আমি তো বলিনি


আমি তো বলিনি

এলিনা নাহার



আমি তো বলিনি
রাস্তার পাশের ঐ সুন্দর বাড়িটার মত
আমার একটা বাড়ি চাই,
... শুধু বলেছি
পাশে রেখ সারাজীবন ।

আমি তো বলিনি
রুনা ভাবির মত
আমাকেও একটা স্বর্নের হার গড়ে দাও,
শুধু বলেছি
নীল পাড়ের একটা তাঁতের শাড়ি কিনে দিও ।

আমি তো বলিনি
আমার নিজেদের একটা গাড়ি চাই,
শুধু বলেছি
হুডখোলা রিকশায় রাতের আকাশ
দেখতে ভীষণ ভালো লাগে ।

আমি তো বলিনি
আমি পৃথিবী ঘুরতে চাই,
শুধু বলেছি
সামর্থ্য হলে একবার সাগর দেখিয়ে এনো ।

তবে কেন তোমার এই ব্যস্ততা,
উপরে উঠবার এই নেশা,
যে তোমাকেই হারিয়ে ফেলছি 'তোমার' থেকে!

Wednesday 9 May 2012

জীবনের হিসাব


জীবনের হিসাব

সুকুমার রায়



বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন , “বলতে পারিস্ সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্ফেলিয়ে হাসে।

বাবু বলেন, “সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”
খানিক বাদে কহেন বাবু,”বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেম্নে আসে পাহাড় হতে নেবে?

বল্ত কেন লবনপোরা সাগরভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই , অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তাকি?
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাকি।”

আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বল্ত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, “আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”

বাবু বলেন, “বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুব্ল বুঝি দুলে।

মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুব্ল নাকি নৌকো এবার ? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো? মাথা নাড়েন বাবু”
মুর্খ মাঝি বলে, “মশাই , এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব কারো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!”

প্যাঁচা আর প্যাঁচানি


প্যাঁচা আর প্যাঁচানি

সুকুমার রায়



প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি,
খাসা তোর চ্যাঁচানি!
শুনে শুনে আন্‌‍মন
নাচে মোর প্রাণমন!
মাজা‐গলা চাঁচা সুর
আহ্লাদে ভরপুর!
গল‐চেরা গমকে
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিট্‌‍কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্!
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক্ ধুক্,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে—
চাঁদামুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু’নয়ান।

কাতুকুতু বুড়ো


কাতুকুতু বুড়ো

সুকুমার রায়



আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি—
কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি।
কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌‍ সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে।
বিদ্‌‍ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে।
কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি—
বেচ্‌‍ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি।
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্‌‍পনা সব আঁকা।
অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি,
ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।”
এই না বলে কুটুৎ ক’রে চিম্‌‍টি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।

Saturday 5 May 2012

ঝরা ফসলের গান


ঝরা ফসলের গান

জীবনানন্দ দাশ



আঁধারে শিশির ঝরে
ঘুমোনো মাঠের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ দুটো ঘুমে ভরে
আজিকে বাতাসে ভাসিয়া আসিছে হলুদ পাতার ঘ্রাণ
... কাশের গুচ্ছ ঝ’রে পড়ে হায়
খ’সে প’ড়ে যায় ধান
বিদায় জানাই-গেয়ে যাই আমি ঝরা ফসলের গান,-
নিভায়ে ফেলিও দেয়ালি আমার খেয়ালের খেলাঘরে!

ওগো পাখি, ওগো নদী,
এতোকাল ধরে দেখেছ আমারে- মোরে চিনে থাকো যদি,
আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,-
যেন আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই!
পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই
গেয়ে যাই আমি,- মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।।

ঝরা ফসলের ভাষা
কে শুনিবে হায়!- হিমের হাওয়ায় বিজন গাঁয়ের চাষা
হয়তো তাহার সুরটুকু বুকে গেঁথে ফিরে যায় ঘরে
হয়তো সাঁঝের সোনার বরণ গোপন মেঘের তরে
সুরটুকু তার রেখে যায় সব,-বুকখানা তবু ভরে
ঘুমের নেশায়,-চোখে চুমো খায় স্বপনের ভালোবাসা!

ওগো নদী, ওগো পাখি,
আমি চলে গেলে আমারে আবার ফিরিয়া ডাকিবে নাকি!
আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,-
জেনো আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই;
পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই,
গেয়ে যাই আমি, – গাহিতে গাহিতে ঘুমে বুজে আসে আঁখি

পতিতা


পতিতা

জীবনানন্দ দাশ



আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে – সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়;
... ... প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে
রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!
সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের পর!
চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী-
মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় – সে যে নারী, সে যে নারী!

সোনালী ডানার শঙ্খচিল


সোনালী ডানার শঙ্খচিল

জীবনানন্দ দাশ



মনে পড়ে সেই কলকাতা–সেই তেরোশো তিরিশ–
বস্তির মতো ঘর,
বৌবাজারের মোড়ে দিনমান
... ট্রাম করে ঘরঘর।
আমাদের কিছু ছিল না তখন
ছিল শুধু যৌবন,
সাগরের মতো বেগুনি আকাশে
সোনালি চিলের মন।

ছেঁড়া শাড়ি পরে কাটাইতে দিন
বাঁটনা হলুদ মাখা
বিভারানী বোস, তোমার দু হাতে
ছিল দুটো শাদা শাঁখা,
শাদা শাঁখা শুধু তোমার দু হাতে
জুটিত না তেল চুলে,
তবুও আমরা দিতাম আকাশে
বকের পাখনা তুলে।

জুটিত না কালি কলমে আমার
কাগজে পড়িত টান,
তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা,
লিখিতাম আমি গান।
পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে
দেয়ালে আঁকিতে ছবি।
আমি বলিতাম–’অবন্তী-বিভা’,
তুমি শুধাইতে ‘ঈগল কবি’

চক্ষে তোমার মিঙ্ যুগ ভাসে
কাঙড়ার ছবি ঐ নীল চোখে
আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর
পুরানো ফরাসি গানের বোকে
সেদিন আমার পথে পথে হাঁটা
সেও তম্বুরা মান্ডলিন
তোমার সেদিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা
বাংলার পট, পুরোনো চীন।

পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে দিয়ে
দুইটি হৃদয় সেই
ডাল তেল নুন জোটে না যাদের
জামা-শাড়ি কিছু নেই,
তবুও আকাশ জয়ের বাসনা
দু:খের গুলি সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল—

শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন
স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি,
মানুষ থাকুক সংসারে পড়ে
আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি।

সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে,
সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই,
আমার কবিতা কেউ কেনে নাকো?
তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই?

ছ মাসের ভাড়া পড়ে আছে না কি?
ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন?
আকাশের নীল পথে পথে তবু
আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ
আকাশের নীল পথ থেকে পথে
জানালার পর জানালা খুলে
ভোরের মুনিয়াপাখির মতন
কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে।

সংসার আজ শিকার করেছে
সোনালি চিলেরা হল শিকার,
আজ আমি আর কবিতা লিখি না
তুমিও তো ছবি আঁকো না আর।
তবুও শীতের শেষে ফাল্গুনে
মাতাল যখন সোনালি বন
তেরোশো তিরিশ—দারিদ্র্য সেই
ফিরে চাই আজ সে যৌবন।

ফিরে চাই আমি তোমারে আবার
আমার কবিতা, তোমার ছবি—
শুধাতাম আমি ‘অনুরাধাপুর’—
শুধাইতে তুমি ‘শকুন কবি’।
সেই-যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন
দুখের ছররা—সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল।

কারা কবে কথা বলেছিল


কারা কবে কথা বলেছিল

জীবনানন্দ দাশ



কারা কবে কথা বলেছিল,
ভালবেসে এসেছিল কাছে,
তারা নাই, তাদের প্রতীক হয়ে তবু
কয়েকটি পুরানো গাছ আছে;
নক্ষত্রেরা রয়ে গেছে নদীর ওপরে;
চারিদিকে প্রান্তর ও ঘাস;
দু'চারটে ঘরবাড়ি নীড় ও শিশির;
কূলে কূলে একলা আকাশ।


যারা ছিল তারা কেও নেই;
জীবন তবুও এক শান্ত বিপ্লবী;
স্থির আগুনের মতো অবিরল আলোক দিতেছে;
আলো ছাড়া দহে যার সবি।


নিশ্চিত মৃত্যুর শুন্য আঁধারের আগে
হে নিঃসঙ্গ বৃ্ক্ষ মনবিহঙ্গম তুমি,
দেখেছিলে জেনেছিলে ভালবেসেছিলে;
দ্রুত পরিবর্তনের পটভূমি
পৃথিবীতে মানুষের যাওয়াআসা তবু
শিগগিরই এ মাটির নিজের স্বভাবে
মিশে সব লোভ প্রেম যুক্তিহীন ধূলো হয়ে যাবে
প্রকৃতির কত শত অনন্ত অমিয়ে।

এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি


এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি

জীবনানন্দ দাশ



এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি — আমি হৃষ্ট কবি
আমি এক; — ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে;
ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ, ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে — ঘাসের আঁচলে
ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি — দেখেছি কিশোরী এস হলুদ করবী
ছিঁড়ে নেয় — বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন শঙ্খের মতো ছবি
ফুটাতেছে — ভোরের আকাশখানা রাজহাস ভরে গেছে নব কোলাহলে
নব নব সূচনার: নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে — তবু কথা বলে,
তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না — কেউ যেন শুনিতেছে সবি


কোন্‌ রাঙা শাটিনের মেঘে বসে — অথবা শোনে না কেউ, শূণ্য কুয়াশায়
মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাবো আমিও এমন;
তবু আজ সবুজ ঘাসের পরে বসে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায়
পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ
কারে যেন এই গুলো দেবো আমি; মৃদু ঘাসে একা — একা বসে থাকা যায়
এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন।

Thursday 26 April 2012

প্রিয় দেশ আমার...


প্রিয় দেশ আমার...

স্ব-রচিত




নতুন মন্ত্র আছে আমার, দেশ সাজাবার
নতুন মন্ত্র আছে আমার, তোমায় কাদাঁবার
...বর্ষায় ভিজবো আমি
...রোদেও পুড়বো আমি...মারবো আমি...মরবো আমি...
...তবু তোমায় ছেড়ে যাবো না আমি,
সব পাপ আমার
সব দুঃখ আমার...
...সব কিছুর পর দায়িত্ব আমার...তোমায় গুছাবার...
প্রিয় দেশ আমার...

শাড়ি চুঁড়ি টিঁপে পুরপুরি বাঙ্গালী সে...


শাড়ি চুঁড়ি টিঁপে পুরপুরি বাঙ্গালী সে...

সংগ্রহিত




…সেই মেয়ে
দু’চোখে তার আকাশ হয়ে থাকে
সন্ধ্যার সোনা রোদ কপালের লাল টিঁপে
…সেই মেয়ে
আকাশের রঙ তার শাড়ি জুড়ে একাকার
মেঘ হয়ে আছে যেন একরাশ কালো চুল
......আমার হৃদয় থমকে দাঁড়ায়
......সূর্য ডোবার মত মন নিমিষে হারায়
…সেই মেয়ে
শাড়ি চুঁড়ি টিঁপে পুরপুরি বাঙ্গালী সে
একাকী হৃদয় বৃন্তে যেন ফুঁটে আছে ফুল
…সেই মেয়ে
যতটা অসাধারন বলা যায় তারও চেয়ে বেশি
অসামান্যা সে
…সেই মেয়ে
প্রেয়সী আমার... প্রেয়সী আমার...

Source : হঠাৎ বৃষ্টি [বাংলা নাটক]

দারুচিনি দ্বীপের পানে...


দারুচিনি দ্বীপের পানে...

স্ব-রচিত



বেদনার অতলে ডুবে, তোমাকে আবারো ছুয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি এখনো
বিকেলের মোম আলোয় তোমাকে দেখবো...
বাস্তব সংকচের মাথায় ঘোল ঢেলে দাড়াব পাশে তোমার...
জানি যদিও তুমি চাইছো ছুতে আমায়, বাহানার অভিনয়ে ধরবো ঐ হাত দুটি....
মুখমুখি বসতে চেয়েছিলে তুমি, কিন্তু হাটবো আমি...তোমায় পাশে নিয়ে
দিগন্তের পথে...
দারুচিনি দ্বীপের পানে...